" উত্তর সিকিমের​ পথে প্রান্তরে " : 1st Part


                  উত্তুঙ্গ পাহাড়শ্রেনী, আদিম অরন্য, খরস্রোতা নদী, হিমশীতল হিমাবাহ, ফুলে ভরা উপত্যকা, উদ্দাম জলপ্রপাতের সংহার মূর্তি, তুষারমৌলী হিমালয়, সীমাহীন অতলস্পর্শী খাদের দেশ "উত্তর সিকিম" আজ পর্যটন মহলে স্বর্গলোকের নন্দনকানন সম ।। পুরো উত্তর সিকিম জুড়ে রয়েছে ৫০০র অধিক জলপ্রপাত, জঙ্গল, পাহাড়, পর্বত, খাদ, মন্দির, গুম্ফা, বরফ, লেক, উপত্যকা, উষ্ণ প্রস্রবণ কত কি ।। মনেহয় ভগবান যখন পৃথিবী বানিয়ে ছিলেন, সর্ব প্রথম উত্তর সিকিম বানিয়ে ছিলেন খুব সময় নিয়ে তাই এখানে উনি ঢেলে দিয়েছেন প্রকৃতির বিপুল সম্ভার, নৈস্বর্গিক শোভা, চোখ জুড়ানো শান্তি, মন ভোলানো প্রশস্তি এখানে এলেই নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে WOW !! What A Destination ; Just Incredible !! উত্তর সিকিম এক বার না এলে জীবনটাই বৃথা। এখানকার সৌন্দর্য বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই, আর সেই আস্পর্ধা দেখাতে চাই না।



                   আমাদের দলে ১২ জন সদস্য (মা বাবা সমেত জন বয়স্ক) থাকায় ্যাংটক থেকে দুটি বলেরো নিয়ে চললাম উত্তর সিকিমের উদ্দেশ্যে। আমাদের গাড়ির চালক মনোজ ভাই খুব দক্ষ, অভিজ্ঞ ,সৎ মজাদার মানুষ, যা আজকালকার দিনে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। উনাকে বলেছিলাম - " আমারা নিজেদের ্যবস্থায় ঘুরতে এসেছি, তাই সব দেখবো এমন মানসিকতা নেই, কিন্তু যেটা ভালো লাগবে ওখানে একটু সময় দেবো" হাসতে হাসতে উনি বললেন " আপলোক টুরিস্ট হো, ঘুমনে আয়েহো, আপলোকো সব কুছ আচ্ছিতারাসে ঘুমানা মেরা কাম হেয়, নাহিতো বুদ্ধাজি মাফ নাহি করেগা" ।।               

                      উনার সাথে আলাপ চারিতা চলতে চলতে আমরা কিছু পাহাড়ী নদীনালা, ছোট্ট ছোট্ট সেতু, পাহাড়ী গ্ৰাম পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম এক জলপ্রপাতের কাছে ্যাংটক থেকে মাত্র ৩২ কিমি দূরে নির্মল প্রকৃতির মাঝে রয়েছে এই অতিব সুন্দর জলপ্রপাতটি। প্রপাতটির জল সাত ধাপে নিচের দিকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে, সাত ধাপে নামার জন্য নামকরণ হয়েছে Saven Sister Waterfalls. পাশে রয়েছে View Point, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে উল্টো দিকের পাহাড় কেটে পাথুরে দেয়ালে বানানো হয়েছে এক অতি সুন্দর বুদ্ধদেবের মূর্তি। আকারে ছোট হলেও দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এখানে আমরা কিছুটা সময় দিয়ে আরো আগে এগিয়ে চললাম আজনা কে জানতে, অচেনা কে চিনতে ।।
Saven Sister Waterfalls

Saven Sister Waterfalls
                  
                          Saven Sister Waterfalls দেখে আমরা আরো এগিয়ে চললাম। রাস্তার এক দিকে খাড়া সবুজ পাহাড় তো অপর দিকে অতলস্পর্শী খাদ। আচানক Manoj ভাই রাস্তার এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের নামতে বললেন, আমরাও যন্ত্রের মতো নেমে পড়লাম। ওখান থেকে তিস্তা নদীকে ছোট্ট ফালির মতো দেখা যাচ্ছে তিস্তা কে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। তাই অনেক উঁচু থেকে তিস্তা দৃশ্যমান দৃশ্যটিউপভোগ্য, মনোজ ভাই কে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না
                     
                      এরপর আমরা একে একে পেরিয়ে গেলাম Milkey Waterfalls, Lande Waterfalls সহ আরো অনেক জলপ্রপাত, কিছু কিছু জলপ্রপাতের নামই তো জানা নেই ড্রাইভাররা নিজেদের মত করে নাম দিয়ে দিয়েছে এই সব মন কাড়া প্রকৃতির অপরুপ শোভা দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি রাস্তার পাশে এক পাকা বাড়ির সামনে থামলো। এখানেই আমাদের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের ব্যবস্থা করা আছে। খাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে খাবারেরনাম শুনতেই পেটের ভেতর ছুঁচোর ডন মারা উপলব্ধি করলাম। আমরাও দেরি না করে বসে পড়লাম, বুফে পদ্ধতিতে খাওয়া দাওয়া। আমাদের মতো অনেকেই এখানে খাবার খেতে বসেছে, বেশ সরগম। বুঝলাম Lunch করার জন্য অনেকেই এই জায়গাটা পছন্দ করেন। মাংস দিয়ে সাঁটিয়ে ভাত খেলাম (মাংস শেষ হতে ডিম ছিল) এরপর আবার এগিয়ে যাওয়ার পালা........
         Lande Waterfalls

Milkey Waterfalls
নাগা জলপ্রপাত :- উত্তর সিকিমের পথে প্রান্তরে
                           লাচেন যাওয়ার পথে আরো একটি সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর জলপ্রপাত হলো "নাগা" গ্যাংটক থেকে মাত্র ৭২ কিমি দূরে এর অবস্থান। ২০১২ সালের ভূমিকম্পে জলপ্রপাতেরউপর ধ্বস নামে, তা আজও বিদ্যমান। মনোজ ভাই এখানেও আমাদের নেমে ঘুরে দেখতে বললেন। প্রচুর পর্যটকেরভীড়, কেউ বা স্নান করছে, কেউ বা পা ডুবিয়ে বসেছে, কেউ বা সেল্ফী নিতে ব্যস্ত। যার সিংহ ভাগই বাঙালি পর্যটক, এদের ভীড়ে মনের মতো ছবি তোলাই দায়
নাগা জলপ্রপাত

                                         নাগা জলপ্রপাত
                সবুজ পাহাড়েরউপর থেকে দোরদাণ্ড জলরাশি বিপুল বেগে ধেয়ে আসছে নিচের দিকে। খুব সুন্দর দৃশ্য। পাশের ঝুপড়ি দোকান থেকে গরম চা পান করতে করতে এই অকৃত্রিম প্রাকৃতিক দৃশ্য পুরো নিংড়ে নিচ্ছিলাম। মাঝে কিছু সময় প্রপাতের জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম, সুন্দর এক অনুভূতি। কিছুক্ষণ পর মনোজ ভাই বললো "এবার চলা দরকার, আগে আরো অনেক কিছু দেখার আছে" আমাদের সম্বিত ফিরল, অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে ফেলেছি, রাস্তা অনেক বাকি। গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। নাগা জলপ্রপাতকে পেছনে রেখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল চুংথাং দিকে।

চুংথাং :- উত্তর সিকিমের পথে প্রান্তরে
                  উত্তর সিকিমের পথে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ হল চুংথাং (৫৯০০ ফুট) গ্যাংটক থেকে ৯৮ কিমি দূরে অবস্থিত এই পাহাড়ী গ্ৰাম থেকেই রাস্তা দ্বিবিভক্ত হয়ে, বাম দিকের রাস্তা চলে গেছে লাচেন (২৬ কিমি) হয়ে গুরুদংমার লেক এবং ডান দিকের রাস্তাটি লাচুং (২০ কিমি) হয়ে জিরো পয়েন্ট
                  চু মানে নদী। চুংথাং অর্থাৎদুই নদীরবিয়ে।এখানেই লাচেন থেকে আসা "লাচেন চু" এবং লাচুং থেকে আসা "লাচুং চু" মিলিত হয়েছে​ , পরে যার নামকরণ হয়েছে "তিস্তা" এছাড়াও চিন সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সেনা জোয়ানদের কাছে এই জনপদের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও বানানো হয়েছে লাচেন চু নদীর উপর হাইড্রাল প্রোজেক্ট
                   খুব সুন্দর দৃশ্যময় পাহাড়ী জনপদ, এক কথায় অসাধারন। চারিদিকে সবুজ পাহাড়, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ঘন নীল রংয়ের লাচেন চু, একটি বৌদ্ধ গুম্ফা, গুরুদুয়ারা, কিছু বাড়ি দোকান এসব নিয়েই চুংথাং ছোট্ট সংসার। জনশ্রুতি, রুপ লাবন্যে মুগ্ধ গুরু রিমপোচে বিশ্রাম করেন এখানে। স্মারকরুপে বৌদ্ধ তীর্থ চুংথাং। চলার পথে গাড়িতে বসেই সব দেখলাম। চোখে পড়ল মদ্যপান করে গাড়ি না চালানোর সতর্কবার্তা। বেশ সুন্দর সাজানো গুছানো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন গ্ৰাম। আমার প্রথম দর্শনেই চুংথাং কে ভালো লেগেছিল, থাকার ইচ্ছে জাগলেও পোগ্ৰাম ওই ভাবে না থাকায় আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে নিলাম, "আবার উত্তর সিকিম বেড়াতে এলে এখানে এক রাত থাকবোই"।। 
চুংথাং
লাচেন-চু গর্ভে :- উত্তর সিকিমের পথে প্রান্তরে (১৭ই এপ্রিল, ২০১৭)
                   চুমথাং পেরিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটছিল লাচেনর উদ্দেশ্য। চুমথাং থেকেই আমাদের সঙ্গী নীল রংয়ের লাচেন-চু। কখনো রাস্তার ডান দিকে, তো আবার কখনো রাস্তার বাম দিকে। মনোজ ভাইকে বললাম কোথাও দাঁড়িয়ে যেতে দু চার টা ফটো তুলবো। উনি এক ইঙ্গিতপূর্ণহাসি দিলেন
                   মাত্র মিনিট পাঁচেক হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ মনোজ ভাই আমাদের বাহনকে নামিয়ে দিলেন নদী লক্ষ করে নিচের দিকে। কালো পীচ রাস্তা ছেড়ে আমার এখন নুড়ি পাথর ভরা নদী গর্ভে। এতো জল না চাইতেই বৃষ্টি। ভাই বোন সবাই আমরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম, এক অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার আনন্দে ধন্যবাদ মনোজ ভাই।

    লাচেন-চু
                        ঘন নীল লাচেন-চু, চারিদিকে নুড়ি পাথর, ওদিকে খাড়া সবুজ পাহাড়, ছোট্ট একটা দ্বীপ, প্রপেলার পাইন গাছের সারি, দূরে এক জলপ্রপাত, সূয্যি মামা ডুবি ডুবি করছে, আমরা ছাড়া চত্তরে আর কেউ নেই। এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি, ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। ভূলে গিয়েছিলাম নিজেদের বয়সবোধ, পৌঁছে গিয়েছিলাম ছোটবেলায়। জল ছিটানো একে অপরকে, নদীতে পাথর ছুড়ে মারা, ঠাণ্ডায় জলে নেমে যাওয়া, ছবি তোলা কি করিনি ??? এর মাঝে কাকিমা খুঁজে পেলো "নোড়া", বাড়ি নিয়ে এসে এটা দিয়ে নাকি মসালা বানাবে। অন্ধকার না হয়া ওব্দি আমরা ওই জায়গা ছেড়ে আসিনি। ফলস্বরূপ লাচেন পৌঁছতে পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা সাতের ঘর ছুঁই ছুঁই ।।



ভাই বোন সবাই আমরা 

                                                                                                                                               ক্রমশঃ..........

No comments

Powered by Blogger.